শ্রীনগরে সরব স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, নৌকার ভরাডুবির শঙ্কা

আরিফুল ইসলাম শ্যামল
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ১০:০৬ PM, ০৫ নভেম্বর ২০২১

আগামী ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে ১১টির মধ্যেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকা প্রার্থীর বিপক্ষে নির্বাচনী মাঠে সরব আছেন স্বতন্ত্র (বিদ্রোহী) প্রার্থীরা। এতে করে এসব ইউনিয়নে ভোট প্রতিযোগিতায় নৌকার ভরাডুবির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনটাই মনে করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রবীন ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা। প্রতীক পাওয়ার পর থেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কর্মী সমর্থকদের নিয়ে নির্বাচনের প্রচার প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। এতে করে কোন কোন ইউনিয়নে স্বতন্ত্র পার্থীর প্রচারণায় নৌকার সমর্থকদের বাঁধা প্রদান হামলা করার অভিযোগও শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২৯ অক্টোবর দুপুরে তন্তরের ব্রাহ্মনখোলায় নির্বাচনী সহিংসতায় আনারসের প্রার্থী সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আলী আকবরের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। নৌকার প্রার্থী জাকির হোসেনের নেতৃত্বে হামলার অভিযোগ উঠে। ওই হামলায় আলী আকবরসহ তার ১৪ সমর্থক আহত হয়। রাতে হামলার ঘটনা ঘটে রাঢ়িখালের বউবাজারে স্বতন্ত্র প্রার্থী হারুন উর রশিদের নির্বাচনী ক্যাম্পে। রাঢ়িখালের নৌকার প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান বারেক খান বারীর সমর্থকদের বিরুদ্ধে এই হামলার অভিযোগ উঠে। এঘটনায় আনারসের প্রায় ১০ জন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। একই রাতে পাটাভোগে স্বতন্ত্র প্রার্থী হাছেন শেখের প্রচারণায় বাঁধা ও আনারসের ক্যাম্প বন্ধের অভিযোগ উঠে নৌকার প্রার্থী মুন খানের সমর্থকদের বিরুদ্ধে। গত কয়েকদিনে ঘোলঘরে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোয়াজ্জেম হোসেন সেন্টুর ২ সমর্থকদের ওপর অজ্ঞাত হামলার অভিযোগ শুনতে পাওয়া যায়। গত সোমবার বাঘড়ায় টেলিফোন প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আল নাসের তানজিলের এক সমর্থককে হুমকি ধমকির দেওয়ার অভিযোগ উঠে নৌকার প্রার্থী নুরুল ইসলাম ও তার ভাইদের বিরুদ্ধে। এছাড়াও বৃহস্পতিবার বিকালে টেলিফোন সমর্থকদের ওপর হামলার খবর শুনতে পাওয়া গেছে। এঘটনায় নারীসহ ৩ জন আহত হয়। এছাড়াও অন্যান্য ইউনিয়নে প্রতিদ্ব›িদ্ব এক পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে নির্বাচন প্রচারণায় বাঁধা প্রদান ও হুমকি ধমকির একাধিক অভিযোগ তুলছেন। কোন কোন ঘটনায় থানায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দায়ের হয়।

হাঁসাড়া: মোট চেয়ারম্যান প্রার্থী ৪ জন। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আহসান হাবীবের নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে আনারস মার্কা নিয়ে নির্বাচনী মাঠে শক্ত অবস্থানে আছেন আওয়ামী লীগ নেতা মো. সোলায়মান খান। গতবার তিনি স্বতন্ত্র থেকে নৌকা মার্কাকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
ষোলঘর: মোট প্রার্থী ৫ জন। আওয়ামী লীগের মনোনীত বর্তমান চেয়ারম্যান আলহাজ মো. আজিজুল ইসলামের নৌকার বিপক্ষে চশমা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছেন আওয়ামী লীগ নেতা মো. মোয়াজ্জেম হোসেন সেন্টু। গেল বার ষোলঘরে নৌকা নিয়ে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আজিজুল ইসলাম। এবারের চিত্রটা একটু ভিন্ন, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক নেতা ও গেল উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. জাকির হোসেনের ছোট ভাই মোয়াজ্জেম হোসেন সেন্টু নির্বাচনী মাঠে থাকায় এখানে হাড্ডা হাড্ডি ভোট লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

শ্যামসিদ্ধি: মোট প্রার্থী ৪ জন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মামুনের বিপক্ষে আনারস প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জিএস নাজির। এছাড়াও গতবারের বিএনপির মনোনীন একমাত্র নির্বাচিত বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান মো. রতন মিয়াও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মোটরসাইকেল মার্কা নিয়ে নির্বাচনী মাঠে আছেন সুবিধাজনক অবস্থানে।

বাঘড়া: মোট প্রার্থী ৫ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের মনোনীত দুই বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের নৌকার প্রতীকের বিপক্ষে ভোট লড়াইয়ে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছেন বাঘড়ার জনপ্রিয় চেয়ারম্যান মরহুম আইয়ুব আলীর ভাতিজা আবু আল নাসের তানজিল। টেলিফোন প্রতীক তরুণ প্রার্থী তানজিল ভোট যুদ্ধে আছেন শক্ত অবস্থানে।

ভাগ্যকুল: মোট প্রার্থী ৫ জন। আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকার প্রার্থী বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান কাজী মনোয়ার হোসেন শাহাদাতের বিপরীতে টেবিলফ্যান প্রতীক নিয়ে মূল প্রতিদ্ব›িদ্ব হিসেবে মাঠে আছেন চাচা শ্বশুর আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম একুল খান। ভাগ্যকুলে জামাই শ্বশুরের ভোট যুদ্ধ জমে উঠেছে।

রাঢ়িখাল: মোট প্রার্থী ৩ জন। গত বারের আওয়ামী লীগের মনোনীত বিজয়ী চেয়ারম্যান আব্দুল বারেক খান বারীর প্রতিপক্ষ সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা হারুন উর রশিদ আনারস মার্কা নিয়ে আছেন শক্ত অবস্থানে।

কোলাপাড়া: মোট প্রার্থী ৪ জন। গেল নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী চেয়ারম্যান হাজী নেছারউল্লাহ সুজনের নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে আওয়ামী লীগের দুই বিদ্রোহী প্রার্থী ভোটের মাঠে শক্ত অবস্থানে আছেন। আনারস নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল ইসলাম বাবু ও ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান জনেট ঘোড়া প্রতীক নিয়ে নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। ধারনা করা হচ্ছে এখানে ভোট যুদ্ধে প্রতিদ্ব›িদ্বতা হবে ২ স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে।

কুকুটিয়া: মোট প্রার্থী ৪ জন। ইউনিয়ন আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক আক্তার হোসেন মিন্টুর নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে শক্ত অবস্থানে আছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান বাবুল হোসেন বাবু। গতবারও আনারস প্রতীক নিয়ে নৌকার প্রার্থী শেখ আব্দুল কাদির লিটনকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। এখানে আওয়ামী লীগ নেতাদের একাধিক গ্রæপিং ও কোন্দলের কারণে নৌকার কর্মী ও সমর্থকরা নির্বাচনী মাছে হতাশায় ভোগছেন। আনারস প্রতীক নিয়ে বাবুল হোসেন বাবু ভোটের রাজনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন।

পাটাভোগ: মোট চেয়ারম্যান প্রার্থী ৪ জন। নৌকার প্রার্থী উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক হামিদুল্লাহ খান মুনের বিপক্ষে শক্ত অবস্থানে আনারস প্রতীকে মুন্সীগঞ্জ জেলা শ্রমিক লীগের সহ-সভাপতি হাছেন শেখ (খোকন)। ধারনা করা হচ্ছে এখানে এই ২ প্রার্থীও মধ্যে তুমুল ভোট লড়াই হবে।

আটপাড়া: মোট প্রার্থী ৫ জন। এখানে উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম মাসুদের নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে গতবারের চশমা নিয়ে এবারও শক্ত অবস্থানে আছেন আওয়ামী লীগ নেতা (দর্জি বাড়ির ফ্যাশনের কর্ণধার) ফজলুর রহমান ও আনারস প্রতীক নিয়ে বিকল্পধারার নেতা বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী খান। গেল বার ইউনিয়নটিতে সাবেক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান বিল্লাহ হোসেনের নৌকা প্রতীক ও ফজলুর রহমানের চশমা প্রতীকতে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আইয়ুব আলী খান। আসন্ন ইউপি নির্বাচনে ভোট প্রতিযোগিতায় চশমা ও আনারস প্রতীকের মূল প্রতিদ্ব›িদ্বতা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তন্তর: মোট প্রার্থী ৬ জন। গত বারের নৌকার বিজয়ী চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেনের নৌকার বিপক্ষে এবারও আনারস প্রতীক নিয়ে শক্ত অবস্থানে আছেন সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আ’লীগের সাবেক সভাপতি আলী আকবর। এছাড়াও এখানে প্রতিদ্ব›িদ্বতায় আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী অটোরিক্সা প্রতীকের নুরুজ্জামান বেপারী। এখানে ত্রিমুখী প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ ভোট লড়াইয়ের ধারনা করা হচ্ছে।

অপরদিকে বীরতারা, বাড়ৈখালী ও শ্রীনগর সদর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আ’লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকলেও ভোটের মাঠে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সরব আছেন। এর মধ্যে বীরতারায় নৌকার প্রার্থী বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান আজিম হোসেন খানের বিপক্ষে শক্ত অবস্থানে আছেন আনারস প্রতীক নিয়ে বিকল্পধারার নেতা সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান গাজী শহিদুল ইসলাম ঝিলু। বীরতারায় মোট প্রার্থী ৪ জন। শ্রীনগর সদর ইউনিয়ন পরিষদে মোট প্রার্থী ৩ জন। এখানে নৌকার প্রার্থী বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমানের বিপক্ষে আনারস প্রতীক নিয়ে ভোট যুদ্ধে প্রতিদ্ব›িদ্বতায় শক্ত অবস্থানে আছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক নেতা তাজুল ইসলাম। এছাড়াও বাড়ৈখালীতে ফারুক হোসেনের নৌকার বিপক্ষে নির্বাচনী মাঠে ঘোড়া প্রতীক নিয়ে আছেন কাঞ্চন বাবু। বাড়ৈখালীতে মোট প্রার্থী ৩ জন। শ্রীনগরের প্রায় ১২টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনীত ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিপরীতে নির্বাচনে প্রচারণা করছেন দলীয় প্রতীক হাতপাখা মার্কার ইসলামী আন্দোলনের মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীরাও। এবারের ইউপি নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত কোন প্রার্থী না থাকায় এখানে বিএনপির নেতাকর্মীরা সুযোগ বুঝে স্বতন্ত্র প্রর্থীদের পক্ষে প্রচারণা করতে দেখা গেছে। উপজেলা বিভিন্ন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রবীন ও ত্যাগী নেতাকর্মী সাথে আসন্ন ইউপি নির্বাচনী আলাপ আলোচনায় এসব তথ্য উঠে আসে। তারা জানান, প্রতিটি ইউনিয়নে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের তৃণমূলে কোন্দল-গ্রæপিং, দলীয় প্রার্থী চুড়ান্তের বিষয়ে অসচেতনতার কারণেই ভোট যুদ্ধে শ্রীনগরের ইউপি নির্বাচনে নৌকার ভরাডুবি হতে পারে। ধারনা করা হচ্ছে ভোট যুদ্ধে উপজেলার প্রায় ১০ থেকে ১২টি ইউনিয়নে নৌকার পরাজয় হতে পারে।

শ্রীনগর উপজেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা যায়, শ্রীনগর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে মোট ভোটার প্রায় ২ লাখ ৫১ হাজার ৭৪৪ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার প্রায় ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৪৩ জন ও পুরুষ ভোটার প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার ৪০১ জন। আগামী ১১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার উপজেলার প্রায় ১২৬টি ভোট কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে ভোটাররা তাদেও ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে পছন্দের জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচিত করবেন। এমনটাই জানান সাধারণ ভোটাররা।

আপনার মতামত লিখুন :