সিরাজদীখানে ট্রলার ঘাট প্রায় ২০ বছর ধরে বিলুপ্ত

মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানে ইছামতী নদীর তীর ঘেঁষে শত বছরের বেশি প্রাচীন সিরাজদীখান বাজার। এ বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতা আসা-যাওয়া এবং দোকানিদের মালামাল আনা-নেওয়ার একমাত্র স্থান ছিল ট্রলার ঘাট। কিন্তু নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এবং রাস্তাঘাট উন্নত হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী ঘাট এখন অস্তিত্ব হারিয়েছে। ঘাটটি প্রায় ২০ বছর ধরে বিলুপ্ত।
সরেজমিনে দেখা যায়, সিরাজদীখান বাজারের তিনটি ট্রলার ঘাট এখন একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন শুধু ঘাট রয়েছে কিন্তু ট্রলার নেই। এখন আর আগের মতো কেউ নদী পথে চলাচল করে না। সবাই সড়ক পথে চলাচল করে থাকে। এর ফলে ঘাট গুলো একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
জানা যায়, মুন্সীগঞ্জ-শ্রীনগর এ দুটি থানা নিয়ে ১৮৪৫ সালে মুন্সীগঞ্জ মহকুমা স্থাপিত হয়। তখন সিরাজদীখান এলাকাটি শ্রীনগর থানার আওতাভুক্ত ছিল। পূর্বে এই স্থানের নাম ছিল ইদ্রাকপুর। ১৮৫৭ সাল থেকে ১৯১২ পর্যন্ত সিরাজদীখান বন্দর নামে পরিচিতি ছিল। তখন সিরাজদীখান বন্দরে কয়েকটি দোকানঘর ব্যতীত বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি।
১৯১৪-১৫ সালের দিকে সিরাজদীখান থানা ও সাবরেজিষ্টার অফিস স্থাপিত হয়। ১৯৮২ সালের ১৫ই ডিসেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের এক আদেশ বলে সিরাজদীখান থানায় রূপান্তর হয়। এর পর থেকে উপজেলা হিসাবে সিরাজদীখান স্বীকৃত পায়। সে সময় ইছামতীর নদীর বুকে লঞ্চ-স্টিমার চলাচল করত।
প্রায় ২০ বছর আগে নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এবং রাস্তাঘাট উন্নত হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী ঘাট এখন অস্তিত্ব হারিয়েছে। এখন ইছামতীর বুকে লঞ্চ আর স্টিমারের হুইসেল বেঁজে উঠে না। হাজারো মানুষ নৌযান চালিয়ে এখন আর জীবিকা নির্বাহ করে না। যৌবনদীপ্ত ইছামতীর তীরে সিরাজদীখান বাজার গড়ে উঠেছিল।
তৎকালীন সময়ে এ বাজার হাজারো মানুষের পথভারে মুখরিত হয়ে উঠত। ইছামতী নদী ঘিরে উপজেলার ইমামগঞ্জ, গিরিগঞ্জ, ইছাপুরা, নোয়াপাড়া, শিংপাড়া, বৌবাজার, নিমতলা, শেখরনগর, মরিচা, সৈয়দপুর, রামকৃঞ্চদী, রাজানগর, বাহের ঘাটা, টেকেরহাট এলাকায় বাজার সরগরম করত। কিন্তু এখন ওই সব বাজারের সামনে ইছামতী মরা খালে পরিণত হয়ে উঠেছে। এ সব বাজারে যাতায়াত করতে এখন আর ডিঙ্গি নৌকাও চলাচল করে না। চলে না ট্রলার কিংবা লঞ্চ। এতে অসংখ্য পরিবার বেকার হয়ে পড়ে। এখন ওই সব পরিবার অন্য পেশা বেছে নিয়েছে।
সিরাজদীখান বাজারের বাশ ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ বলেন, আমি যুবক কাল থেকেই সিরাজদীখান বাজারে ট্রলার ঘাটে বাশের ব্যবসা করেছি। এখন আমার বয়স হয়ে যাওয়ায় আমার ছেলে ব্যবসা করে। আমি ১২ বছর আগে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছি। আমি যখন ব্যবসা করতাম তখন অনেক দূর দূরান্ত থেকে বড় বড় নৌকা, ট্রলার, লঞ্চ চলাচল করত। এখন এগুলো সবই স্মৃতি হয়ে রয়েছে। রাস্তাঘাট হওয়ায় এখন নদী পথে নৌকা দিয়ে কেউ চলাচল করে না। সবাই এখন গাড়ি-ঘোড়ায় চলাচল করে।
সিরাজদীখান বাজারের ব্যবসায়ী মো.আক্তার হোসেন বলেন, আমি ১৯৯০-৯২ থেকে সিরাজদীখান বাজারে পাইকারী ব্যবসা করে আসছি। তখন দেখেছি বিভিন্ন এলাকা থেকে এই বাজারে মানুষজন আসা-যাওয়া করত। আমার বড় ব্যবসা হওয়ার কারণে বিভিন্ন এলাকা থেকে মালামাল কিনে আনতে হত। তখন নদী পথ ছাড়া অন্য পথ ছিলনা। তাই আমাদের দোকানের জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে মালামাল কিনে আনতাম নৌকা-ট্রলারযোগে। আমাদের দোকান থেকে খুচরা বিক্রেতারা কিনে গ্রামে নিয়ে বিক্রি করত এবং মানুষজনের জনসমাগম হত অনেক। কিন্তু প্রায় ১০-১৫ বছর আগে নৌকা- ট্রলার চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তাঘাট উন্নত হওয়ায় আমাদের গাড়ি দিয়ে মালামাল আনতে হয়। এতে অনেক খরচ বেড়ে গেছে। আর নৌকা-ট্রলারে আনলে খরচ অনেকটাই কম হত। এখন এগুলো সব স্মৃতি।
সিরাজদীখান বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো.মোতাহার হোসেন বলেন, শত বছরের আগে সিরাজদীখান বন্দর হিসেবে পরিচিতি ছিল। এ বাজারে তিনটি ট্রলার ঘাট দিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন আসা-যাওয়া করত এবং দোকানিদের মালামাল আনা-নেওয়ার একমাত্র স্থান ছিল। রাস্তাঘাট উন্নত হওয়ায় নৌপথ বন্ধ হয়ে মানুষ আর নৌকা- ট্রলারে চলাচল করে না। এখন মানুষ গাড়ি-ঘোড়া চলাচল করে। তাই ট্রলার ঘাট গুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন শুধু স্বপ্ন, স্বপ্নই রয়ে গেছে।#