ঐতিহ্যের স্মারক বিক্রমপুর জাদুঘর

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাহার আড়িয়ল বিল। আর এই বিলের ধারেই শ্রীনগর উপজেলার রাঢ়িখালের বালাশুর গ্রামে গড়ে তুলেছিলেন যদুনাথ রায় বাহাদুর তার জমিদার বাড়ি। করোনাকালীন সময়ে সাময়িক বন্ধ রাখা হলেও এরই মধ্যে দর্শনার্থীর জন্য খোলা হয়েছে বিক্রমপুর জাদুঘরটি। মনোমুগ্ধকর পুরোনো বাড়িটিতে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে একই রকম দেখতে কারুকাজ সজ্জ্বিত মুখোমুখি দুটি জরাজীর্ণ প্রাসাদ। দেখা যাবে কাচারী ঘর, দূর্গা মন্দির, লক্ষী মন্দির ও বিভিন্ন প্রজাতির দূর্লভ সব ফুল ও ফলজ গাছগাছালি। এক সময় বাড়িটিতে পূর্ণিমা তিথীতে খুব ঘটা করে পালন হতো রাশ উৎসব। বাড়িটির চারপাশ এক সময় রাতের আধাঁরে আলোয় ঝলমল করতো। প্রথা বিরোধী লেখক ভাষা বিজ্ঞানী ড. হুমায়ূন আজাদ তার লেখা এক প্রবন্ধে বাড়িটিকে প্যারিস শহরের সাথে তুলনা করে লিখেছেন বিলের ধারে প্যারিস শহর।
সবুজ গাছ গাছালিতে ঢাকা। সকাল-সন্ধ্যায় পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ। তার মাঝে বিশাল বিশাল পুকুর। পুকুরের চারপাশেই শ্বেতপাথরে নির্মাণ করা শানবাঁধানো ঘাট। ঘাটের চারপাশের সিঁড়িগুলো পুকুরের মাঝখানে এসে একত্রে মিলিত হয়েছে। পুকুরগুলো খুব গভীর যার কারণে সব সময়ই থাকে অথৈ পানি। জমিদার যদুনাথ রায়ের বাড়িটির স্মৃতি রক্ষার্থে প্রায় সাড়ে ১৩ একর জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিক্রমপুর জাদুঘর। অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ও সরকারি অর্থায়ণে নির্মাণ করা হয়েছে জাদুঘর, গেস্ট হাউজ। জাদুঘরের প্রথম তলায় দুইটি গ্যালারি করা হয়েছে। গ্যালারি দুইটির নামকরণ করা হয়েছে জমিদার যদুনাথ রায় ও বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যান্য গ্যালারি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মহামারি করোনাকালীন সময় কাটিয়ে এরই মধ্যে দর্শনার্থীদের জন্য খোলা হয়েছে বিক্রমপুর জাদুঘরটি। শনিবার-বুধবার সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দুপুর ২ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকছে জাদুঘরটি। কোনও প্রবেশ মূল্য রাখা হয় না। ভবনে মোট ৭টি গ্যালারীতে রাখা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব নির্দশন। একটি গ্যালারীতে নতুন মাত্রায় যোগ হয়েছে রঘু রামপুর ও নাটেশ্বর থেকে প্রাপ্ত কিছু মহামূল্যবান নির্দশন। এসব নির্দশন বিক্রমপুরের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহন করছে।
অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন শ্রীনগর কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক লেখক মুজিব রহমান জানান, বিক্রমপুরের রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এক সময় পূর্ব বঙ্গ বা সমতটের রাজধানী ছিল আদি বিক্রমপুর। আর এই মাটিতেই জন্মগ্রহন করেছেন অনেক নামকরা ব্যক্তিবর্গ। বিক্রমপুরের মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে হাজার বছর আগের নৌকা, কাঠের ভাস্কর্য, পাথরের ভাস্কর্য, টেরাকোটাসহ অসংখ্য অমূল্য প্রতœবস্তু। এসব অতীত ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে প্রদর্শনের জন্য অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন এখানে বিক্রমপুর জাদুঘর। “আমরা আলোর পথযাত্রী” শ্লোগানকে সামনে রেখে দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনটি এই অঞ্চলে কাজ করে যাচ্ছে।
ঘুরে আসতে পারেন : মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার রাঢ়িখাল ইউনিয়নের বালাশুরে অবস্থিত জমিদার যদুনাথ রায়ের বাড়িটি। যেখানে নির্মাণ করা হয়েছে বিক্রমপুর জাদুঘর। বিক্রমপুর সমন্ধে অনেক অজানা তথ্য হয়ত এই জাদুঘর ভ্রমণের মধ্যে দিয়েই জানতে পারেন। দেখতে পাবেন শত শত বছর আগে জমিদার পরিবারের ব্যবহারিক সব আসবাবপত্র, ধাল-তলোয়াল, কাঠের নৌকা, কামানের অংশ বিশেষ, মূল্যবান পাথরের ভাস্কর্যসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র যা কি’না যুগযুগ ধরে মুন্সীগঞ্জ তথা বিক্রমপুরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের স্মারক।
কিভাবে আসবেন : ঢাকার গুলিস্তান বা পোস্তাগোলা থেকে শ্রীনগর হয়ে দোহারের যাত্রীবাহী বাসগুলো কিছুক্ষণ পরপরই ছেড়ে আসছে এদিকে। সময় লাগবে প্রায় ৪০-৬০ মিনিট। নামতে হবে ভাগ্যকুলে বালাশুর চৌরাস্তায়। এখান থেকে যে কোনও রিক্সা কিংবা ইজিবাইকে করে প্রায় ১০ মিনিটের রাস্তা শেষে জমিদার যদুনাথ রায়ের বাড়ি অর্থাৎ বিক্রমপুর জাদুঘর। এসব পরিবহনে আসতে সর্বমোট ভাড়া লাগবে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।
এছাড়াও সময় পেলে ঘুরে আসতে পারেন একই এলাকার রাঢ়িখালের শ্রীনগর-দোহার সড়ক সংলগ্ন জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর পৈত্রিক বাড়িটিও। এখানে বিজ্ঞানীর স্মৃতি চারনে গড়ে তোলা হয়েছে স্যার জেসি বোস কমপ্লেক্স ও পিকনিক কর্নার। পর্যটকদের জন্য সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু কমপ্লেক্স ও জাদুঘরটি খোলা রাখা হয়। প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি মাত্র ২০ টাকা। ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকে বিখ্যাত ঘোলের স্বাদ নিতে যেতে পারেন পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষা ঐতিহ্যবাহী ভাগ্যকুল বাজারে। বিখ্যাত ঘোল ও সুস্বাদু দইসহ বাহারী সব মিষ্টি পাওয়া যাবে ভাগ্যকুল বাজারের কয়েকশত বছরের পুরনো গোবিন্দ মিষ্টান্ন ভান্ডারে।